নজর ব‌ন্দি


ভ্রর সা‌থে আমার সে‌দি‌নের আচরনটা মো‌টেও ম‌নে রাখার মত কোন স্মৃ‌তি না। এ‌কেবা‌রে নিষ্ঠু‌র হৃদয়হীনার মত সর্বশ‌ক্তিতে ক‌ষি‌য়ে থাপ্পর মে‌রে‌ছিলাম ওর গা‌লে। য‌দিও এটা স্বীকার করা ঠিক না তবু ম‌নে হ‌চ্ছিল আ‌মি হা‌তেও ব্যথা পে‌য়েছিলাম। ওর গাল লাল হ‌য়ে গেল যতটা না ব্যথায় তার চে‌য়ে বে‌শি লজ্জায়। ক্লা‌সের সবগু‌লো ছে‌লে মে‌য়ের সাম‌নেই মে‌রে‌ছিলাম ও‌কে। কেউ কেউ অবাক হ‌য়ে তা‌কি‌য়ে ছিল। কেউ কেউ ফিস‌ফিস কর‌ছিল। মুখ টি‌পে হাস‌ছিলও দু'এক জন। অভ্র কেবল মাথা নিচু ক‌রে দাঁ‌ড়ি‌য়ে ছিল। আর আ‌মি রা‌গে ফুঁস‌তে ফুঁস‌তে ক্লাস ছে‌ড়ে চ‌লে এ‌সে‌ছিলাম। প‌রের দিন ক্লা‌সে যাওয়ার পর আমার অবাধ্য চোখ বারবার খুঁজে ফির‌ছিল আ‌রেক জোড়া অবাধ্য চোখ‌কে। সে‌দিন অভ্র ক্লা‌সে আ‌সে‌নি। আস‌বেই বা কি ক‌রে। বেচারা‌কে সবার সাম‌নে ওভা‌বে চড় মারাটা ঠিক হয়‌নি বোধহয়। লজ্জা পে‌য়ে‌ছে খুব। নি‌জে‌কে প্র‌বোধ দিলাম। ওর জন্য ওটাই ঠিক হ‌য়ে‌ছে। কত‌দিন নি‌ষেধ ক‌রে‌ছি আমার পেছ‌নে বেহায়ার মত ঘুরঘুর কর‌বি না। কর‌বি না। কে শো‌নে কার কথা। স্কু‌লে যাওয়ার প‌থে সবসময় পেছন পেছন আসত। ক্লা‌সে সবসময় আমার সোজা‌সো‌জি বে‌ঞ্চে বসত। যখনই ওর দি‌কে চোখ পড়ত দেখতাম একম‌নে আমার দিকেই তা‌কি‌য়ে আ‌ছে। সবসময় এটা ভে‌বে অস্ব‌স্তি লাগত যে এক জোড়া চোখ সর্বদা আমা‌কে দেখ‌ছে। এমন‌কি বাসা‌তেও আমার এই অনুভূ‌তি হ‌তে লাগল যে অভ্র বু‌ঝি এখনও আমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে আ‌ছে। এম‌নি‌তে চুপচাপ ধর‌নের ছে‌লে। ক্লা‌সে কারও সা‌থে কথাও ব‌লে না খুব একটা। পড়া‌লেখায় আহাম‌রি না হ‌লেও ভা‌লো ব‌লে চা‌লি‌য়ে দেয়া যায়। মোটামু‌টি ভদ্র ব‌লেই ওকে জানত সবাই। কিন্তু এগু‌লো ওর বাই‌রের রুপ। ও‌ যে ত‌লে ত‌লে একটা মিন‌মি‌নে শয়তান এটা আমার থে‌কে ভা‌লো আর কে জা‌নে। ওর প্র‌তি আমার ধারনা এতটাই নিচু ছিল। ক্লাস নাই‌নের বছর ও আমা‌দের স্কু‌লে ভ‌র্তি হ‌য়ে‌ছিল‌। একবছরও হয় নি একসা‌থে পড়া‌লেখা কর‌ছি। অথচ এইটুকু সম‌য়ের ম‌ধ্যেই ও আমা‌কে জ্বা‌লি‌য়ে মে‌রে‌ছে। অবশ্য শুধু দৃ‌ষ্টি দি‌য়েই যে কাউ‌কে এতটা বিরক্ত করা যায় ধারনা ছিল না আমার। যখন রাস্তায় আমা‌কে ফ‌লো কর‌তো মা‌ঝে মা‌ঝে ডে‌কে ধম‌কে দিতাম। কিচ্ছু বল‌তো না। কেবল মাথা নিচু ক‌রে শুনত। কিন্তু ওই শোনা পর্যন্তই শেষ। আবারও পেছন পেছন চল‌তে থাকত। কিন্তু জে‌রি‌নের কা‌ছে যে‌দিন শুনলাম অভ্র না‌কি সবাই‌কে ব‌লে বেড়া‌চ্ছে যে আ‌মি না‌কি ওকে ভা‌লোবা‌সি। ও না‌কি আমার বয়‌ফ্রেন্ড। কথাটা শু‌নেই মাথায় রক্ত চ‌ড়ে গি‌য়ে‌ছিল। এত বড় দুঃসাহস ওর। ওর ম‌তো একটা ছে‌লের সা‌থে প্রেম করব!তাও আবার আ‌মি? স‌ত্যি বল‌তে অহংকার শব্দটা তখন আমার র‌ন্ধ্রে র‌ন্ধ্রে মি‌শে ছিল। ঔদ্ধত্যও ছিল সমা‌নে। সোজা ক্লা‌সে চ‌লে গেলাম। ক্লাস ভ‌র্তি ছে‌লে মে‌য়ের সাম‌নে জি‌জ্ঞেস করলাম। ও এসব গুজব ছ‌ড়ি‌য়ে‌ছে কিনা। বরাব‌রের ম‌তোই নিশ্চুপ ছে‌লেটা। ওর নীরবতা আমা‌কে আরও রা‌গি‌য়ে দি‌য়ে‌ছিল। এবং আ‌মি শেষ‌মেশ ও‌কে স‌ত্যি থাপ্পর মে‌রে‌ছিলাম। কোন অপরাধ‌বোধ আ‌সে‌নি তখন ম‌নে। ওর প্র‌তি কি এক প্রবল ঘৃনা জমা ছিল ম‌নের ম‌ধ্যে। অকারন ক্ষোভ। পর‌দিন ও স্কু‌লে আসে‌নি। ভাবলাম উ‌চিত শিক্ষা হ‌য়ে‌ছে ওর। কিন্তু আমার মন ক্ষ‌নি‌কের জন্য হ‌লেও কেঁ‌পে উ‌ঠে‌ছিল। ও আ‌সে‌নি তার প‌রের দিনও। তার প‌রের দিনও অনুপ‌স্থিত। অনা‌মিকা ম্যাডাম যখন কেমি‌স্ট্রি ক্লা‌সে গম্ভীর ক‌ন্ঠে রোল কল ক‌রেন,রোল নাম্বার থ্রি। সাড়া না পে‌য়ে নাম ধ‌রে ডা‌কেন‌। অভ্র মাহমুদ আ‌ছো? না নেই। কেউ ব‌লে না, প্রে‌জেন্ট ম্যাডাম। আমার কান খাড়া হ‌য়ে থা‌কে। এম‌নি‌তেও এই রোল ক‌লের প্রে‌জেন্ট ম্যাডাম কথাটুকু ব্যতীত অভ্রর মু‌খে আর কোন কথা শোনা যেত না ক্লা‌সে। আ‌মি হঠাৎ এই একটুক‌রো কথা শোনার জন্যই ব্যস্ত হ‌য়ে পড়লাম। ক্লা‌সে আমার চোখদু‌টো ঘু‌রে‌ফি‌রে এক‌জোড়া অবাধ্য কিন্তু মুগ্ধ দৃ‌ষ্টি‌তে তা‌কি‌য়ে থাকা চোখ‌কে খুঁজত। হঠাৎ-ই আ‌মি জান‌তে পারলাম যে অপরা‌ধে আ‌মি অভ্রর সা‌থে দুর্ব্যবহার ক‌রে‌ছি সেই অপরাধ সে ক‌রেই নি। আমা‌দের ক্লা‌সেরই কোন দুষ্টু ছে‌লে র‌টি‌য়ে‌ছিল সে গুজব। অভ্রর প্র‌তি যে তীব্র ঘৃনা আর ক্ষোভ ছিল, ওর দীর্ঘ অনুপ‌স্থি‌তি‌তে সেই ক্ষোভ প‌রিনত হল গভীর বেদনায়। প্র‌তি‌দিন পথ চলার সময় অনুসরনরত যে দৃ‌ষ্টি‌কে আমার অসহ্য ম‌নে হত আজ আ‌মিই বারবার পেছ‌নে ফি‌রে সেই দৃষ্টির অ‌ধিকারী‌কে খুঁজি। কিন্তু সে আর আসে না। ওর কোন ঠিকানাও জা‌নি না আ‌মি। কেবল নিরন্তর প্রতীক্ষা। কিছু‌দিন প‌রে সহপাঠী‌দের মু‌খে শুনলাম ওর বাবা না‌কি স্কুল থে‌কে টি‌সি নি‌য়ে গে‌ছেন। ও আর এখা‌নে পড়‌বে না। এত তীব্র অভিমানী ছে‌লেটা। আর কখ‌নো দেখা হয় নি। প‌রে বহুবার ভে‌বে‌ছি কিই বা দোষ ছিল ওর। কেবল তো একটু তা‌কি‌য়েই থাকত। কখ‌নো কিছু বলত না। বিরক্ত করত না। কেবল দূর থে‌কেই তো দেখত। এই সহজ ব্যাপ‌ারটা আ‌মি কত জ‌টিলতা নি‌য়েই না ভে‌বে‌ছি।‌ কিন্তু এখন আর প্র‌তিকা‌রের উপায় নেই। সে চ‌লে গে‌ছে নি‌জের দৃ‌ষ্টি‌কে সংযত করে আমার দৃ‌ষ্টির আড়া‌লে।
এসবই বহু‌দিন আ‌গের কথা। স্কুল ক‌লে‌জের পাট চু‌কি‌য়ে সংসার জীব‌নে প্র‌বেশ করে‌ছি তাও কম‌দিন হ‌লো না। তবু ব্যস্ততার ফাঁ‌কে যখনই একলা থা‌কি ম‌নে হয় ‌যেন এক‌জোড়া চোখ পূর্ন দৃ‌ষ্টি‌তে আমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে আ‌ছে। শত শত লো‌কের ভী‌ড়ে যখন পথ চ‌লি তখনও ম‌নে হয় একবার পেছ‌নে তাকা‌লেই দেখ‌তে পা‌বো সেই লাজুক ছে‌লেটার অনুসরনরত পূর্ন দৃ‌ষ্টি। অ‌ভিমা‌নে অপমা‌নে যে ছে‌লেটা‌কে আ‌মি এক‌দিন জীবন থে‌কে তা‌ড়ি‌য়ে দি‌য়ে‌ছিলাম সম‌য়ের কাঠগড়ায় আজও আ‌মি সেই ছে‌লে‌টির দৃ‌ষ্টি‌তেই ব‌ন্দি হ‌য়ে আ‌ছি। প্রকৃ‌তির এ‌কি অদ্ভুত নিয়ম। সে‌দি‌নের সেই ছোট্ট ঘটনার ব্যা‌প্তি এখন আমার জীব‌ন জু‌ড়ে কিংবা তার চাই‌তেও বে‌শি। মুক্ত স্বাধীন জীব‌নে কত শত দৃশ্যমান মানু‌ষের পৃ‌থিবী‌তে আ‌মি একজোড়‌া অদৃশ্য ‌চো‌খের নজর ব‌ন্দি..
Next Post Previous Post